তোমারে বন্দনা করি স্বপ্ন-সহচরী লো আমার অনাগত প্রিয়া, আমার পাওয়ার বুকে না-পাওয়ার তৃষ্ণা-জাগানিয়া! তোমারে বন্দনা করি হে আমার মানস-রঙ্গিণী, অনন্ত-যৌবনা বালা, চিরন্তন বাসনা-সঙ্গিনী! তোমারে বন্দনা করি নাম-নাহি-জানা ওগো আজো-নাহি-আসা! আমার বন্দনা লহ, লহ ভালবাসা গোপণ-চারিণী মোর, লো চির-প্রেয়সী! সৃষ্টি-দিন হ’তে কাঁদ’ বাসনার অন্তরালে বসি’ ধরা নাহি দিলে দেহে। তোমার কল্যাণ-দীপ জ্বলিলে না দীপ-নেভা বেড়া-দেওয়া গেহে। অসীমা!এলে না তুমি সীমারেখা-পারে! স্বপনে পাইয়া তোমা’স্বপনে হারাই বারে বারে অরুপা লো!রহি হ’য়ে এলে মনে, সতী হ’য়ে এলে না ক’ ঘরে। প্রিয় হ’য়ে এলে প্রেমে, বধূ হয়ে এলে না অধরে! দ্রাক্ষা-বুকে রহিলে গোপনে তুমি শিরীন্ শরাব, পেয়ালায় নাহি এলে!- ‘উতারো নেকার’ হাঁকে মোর দুরন্ত কামনা! সুদুরিকা!দূরে থাক’ভালোবাসা-নিকটে এসো না।
তুমি নহ নিভে যাওয়া আলো, নহ শিখা। তুমি মরীচিকা, তুমি জ্যোতি। জন্ম-জন্মান্তর ধরি’লোকে-লোকান্তরে তোমা’ করেছি আরতি, বারে বারে একই জন্মে শতবার করি! যেখানে দেখেছি রূপ,-করেছি বন্দনা প্রিয়া তোমারেই স্মরি’। রূপে রূপে, অপরূপা, খুঁজেছি তোমায়, পবনের যবনিকা যত তুলি তত বেড়ে যায়! বিরহের কান্না-ধোওয়া তৃপ্ত হিয়া ভরি’ বারে বারে উদিয়াছ ইন্দ্রধনুসমা, হাওয়া-পরী প্রিয় মনোরমা! ধরিতে গিয়োছি-তুমি মিলায়েছ দূর দিগ্বলয়ে ব্যথা-দেওয়া রাণী মোর, এলে না ক’ কথা কওয়া হ’য়ে।
চির-দূরে থাকা ওগো চির-নাহি-আসা! তোমারে দেহের তীরে পাবার দুরাশা গ্রহ হ’তে গ্রহান্তরে ল’য়ে যায় মোরে! বাসনার বিপুল আগ্রহে- জন্ম লভি লোকে-লোকান্তরে! উদ্বেলিত বুকে মোর অতৃপ্ত যৌবন-ক্ষুধা উদগ্র কামনা, জন্ম তাই লভি বারে বারে, না-পাওয়ার করি আরাধনা! যা-কিছু সুন্দর হেরি’ ক’রেছি চুম্বন, যা-কিছু চুম্বন দিয়া ক’রেছি সুন্দর- সে-সবার মাঝে যেন তব হরষণ অনুভব করিয়াছি!-ছুঁয়েছি অধর তিলোত্তমা, তিলে তিলে! তোমারে যে করেছি চুম্বন প্রতি তরুণীর ঠোঁটে প্রকাশ গোপন।
যে কেহ প্রিয়ারে তার চুম্বিয়াছে ঘুম-ভাঙা রাতে, রাত্রি-জাগা তন্দ্রা-লাগা ঘুম-পাওয়া প্রাতে, সকলের সাথে আমি চুমিয়াছি তোমা’ সকলের ঠোঁটে যেন, হে নিখিল-প্রিয়া প্রিয়তমা! তরু, লতা, পশু, পাখী, সকলের কামনার সাথে আমার কামনা জাগে,-আমি রমি বিশ্ব-কামনাতে! বঞ্চিত যাহারা প্রেমে, ভুঞ্জে যারা রতি- সকলের মাঝে আমি-সকলের প্রেমে মোর গতি! যে-দিন স্রষ্টার বুকে জেগেছিল আদি সৃষ্টি-কাম, সেই দিন স্রষ্টা সাথে তুমি এলে, আমি আসিলাম। আমি কাম, তুমি হ’লে রতি, তরুণ-তরুণী বুকে নিত্য তাই আমাদের অপরূপ গতি! কী যে তুমি, কী যে নহ, কত ভাবি-কত দিকে চাই! নামে নামে, অ-নামিকা, তোমারে কি খুঁজিনু বৃথাই? বৃথাই বাসিনু ভালো? বৃথা সবে ভালোবাসে মোরে? তুমি ভেবে যারে বুকে চেপে ধরি সে-ই যায় স’রে। কেন হেন হয়, হায়, কেন লয় মনে- যারে ভালো বাসিলাম, তারো চেয়ে ভালো কেহ বাসিছে গোপনে।
সে বুঝি সুন্দরতর-আরো আরো মধু! আমারি বধূর বুকে হাসো তুমি হ’য়ে নববধূ। বুকে যারে পাই, হায়, তারি বুকে তাহারি শয্যায় নাহি-পাওয়া হ’য়ে তুমি কাঁদ একাকিনী, ওগো মোর প্রিয়ার সতিনী। বারে বারে পাইলাম-বারে বারে মন যেন কহে- নহে, এ সে নহে! কুহেলিকা! কোথা তুমি? দেখা পাব কবে? জন্মেছিলে জন্মিয়াছ কিম্বা জন্ম লবে? কথা কও, কও কথা প্রিয়া, হে আমার যুগে-যুগে না-পাওয়ার তৃষ্ণা-জাগানিয়া!
কহিবে না কথা তুমি! আজ মনে হয়, প্রেম সত্য চিরন্তন, প্রেমের পাত্র সে বুঝি চিরন্তন নয়। জন্ম যার কামনার বীজে কামনারই মাঝে সে যে বেড়ে যায় কল্পতরু নিজে। দিকে দিকে শাখা তার করে অভিযান, ও যেন শুষিয়া নেবে আকাশের যত বায়ু প্রাণ। আকাশ ঢেকেছে তার পাখা কামনার সবুজ বলাকা!
প্রেম সত্য, প্রেম-পাত্র বহু-আগণন, তাই-চাই, বুকে পাই, তবু কেন কেঁদে ওঠে মন। মদ সত্য, পাত্র সত্য নয়! যে-পাত্রে ঢালিয়া খাও সেই নেশা হয়! চির-সহচরী! এতদিনে পরিচয় পেনু, মরি মরি! আমারি প্রেমের মাঝে রয়েছ গোপন, বৃথা আমি খুঁজে মরি’ জন্মে জন্মে করিনু রোদন। প্রতি রূপে, অপরূপা, ডাক তুমি, চিনেছি তোমায়, যাহারে বাসিব ভালো-সে-ই তুমি, ধরা দেবে তায়! প্রেম এক, প্রেমিকা সে বহু, বহু পাত্রে ঢেলে পি’ব সেই প্রেম- সে শরাব লোহু। তোমারে করিব পান, অ-নামিকা, শত কামনায়, ভৃঙ্গারে, গোলাসে কভু, কভু পেয়ালায়!
বল বীর - বল উন্নত মম শির! শির নেহারি আমারি, নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রীর! বল বীর - বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি' চন্দ্র সূর্য্য গ্রহ তারা ছাড়ি' ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া, খোদার আসন "আরশ" ছেদিয়া উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর! মম ললাটে রুদ্র-ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর! বল বীর - আমি চির-উন্নত শির! আমি চিরদুর্দ্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস, মহা- প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস, আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর! আমি দুর্ব্বার, আমি ভেঙে করি সব চুরমার! আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল, আমি দ'লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃংখল! আমি মানি নাকো কোনো আইন, আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম, ভাসমান মাইন! আমি ধূর্জ্জটী, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর! আমি বিদ্রোহী আমি বিদ্রোহী-সূত বিশ্ব-বিধাত্রীর! বল বীর - চির উন্নত মম শির! আমি ঝঞ্ঝা, আমি ঘূর্ণী, আমি পথ-সম্মুখে যাহা পাই যাই চূর্ণী! আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ, আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ। আমি হাম্বীর, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল, আমি চল-চঞ্চল, ঠুমকি' ছমকি' পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি' ফিং দিয়া দিই তিন দোল্! আমি চপলা-চপল হিন্দোল! আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা', করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা, আমি উন্মাদ, আমি ঝঞ্ঝা! আমি মহামারী, আমি ভীতি এ ধরিত্রীর। আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ণ চির-অধীর। বল বীর - আমি চির-উন্নত শির! আমি চির-দুরন্ত-দুর্ম্মদ, আমি দুর্দ্দম, মম প্রাণের পেয়ালা হর্দ্দম্ হ্যায়্ হর্দ্দম্ ভরপুর মদ। আমি হোম-শিখা, আমি সাগ্নিক, জমদগ্নি, আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি! আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান, আমি অবসান, নিশাবসান। আমি ইন্দ্রাণি-সূত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য্য, মম এক হাতে-বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ-তূর্য্য। আমি কৃষ্ণ-কন্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা বারিধির। আমি ব্যোমকেশ, ধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর। বল বীর - চির উন্নত মম শির। আমি সন্ন্যাসী, সুর-সৈনিক আমি যুবরাজ, মম রাজবেশ ম্লান গৈরিক! আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস, আমি আপনা ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ! আমি বজ্র, আমি ঈশান-বিষাণে ওঙ্কার, আমি ইস্ত্রাফিলের শিঙ্গার মহা-হুঙ্কার, আমি পিনাক-পাণির ডমরু-ত্রিশূল, ধর্ম্মরাজের দন্ড, আমি চক্র ও মহাশঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ-প্রচন্ড! আমি ক্ষ্যাপা দুর্বাসা-বিশ্বামিত্র-শিষ্য, আমি দাবানল-দাহ, দাহন করিব বিশ্ব! আমি প্রাণ-খোলা-হাসি উল্লাস, - আমি সৃষ্টি-বৈরী মহাত্রাস, আমি মহা-প্রলয়ের দ্বাদশ রবির রাহু-গ্রাস! আমি কভু প্রশান্ত, - কভু অশান্ত দারুণ স্বেচ্ছাচারী, আমি অরুণ খুনের তরুণ, আমি বিধির দর্প-হারী! আমি প্রভঞ্জনের উচ্ছাস, আমি বারিধির মহাকল্লোল, আমি উজ্জ্বল আমি প্রোজ্জ্বল, আমি উচ্ছল জল-ছল-ছল, চল-ঊর্মির হিন্দোল্ দোল! আমি বন্ধন-হারা কুমারীর বেণী, তন্বী-নয়নে বহ্নি, আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম-উদ্দাম, আমি ধন্যি। আমি উন্মন মন উদাসীর, আমি বিধাতার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা-হুতাশ আমি হুতাশীর! আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির-গৃহহারা যত পথিকের, আমি অবমানিতের মরম-বেদনা, বিষ-জ্বালা, প্রিয়-লাঞ্ছিত বুকে গতি ফের! আমি অভিমানী চির-ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়, চিত- চুম্বন-চোর-কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম পরশ কুমারীর! আমি গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল ক'রে দেখা অনুখন, আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা, তা'র কাঁকন-চুড়ির কন্-কন্। আমি চির-শিশু, চির-কিশোর, আমি যৌবন-ভীতু পল্লীবালার আঁচর কাঁচলি নিচোর! আমি উত্তর-বায়ু, মলয়-অনিল, উদাসী পূরবী হাওয়া, আমি পথিক-কবির গভীর রাগিণী, বেণু-বীনে গান গাওয়া! আমি আকুল নিদাঘ-তিয়াসা, আমি রৌদ্র রবি, আমি মরু-নির্ঝর ঝর-ঝর, আমি শ্যামলিমা ছায়া-ছবি! - আমি তুরিয়ানন্দে ছুটে চলি এ কি উন্মাদ, আমি উন্মাদ! আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ! আমি উত্থান, আমি পতন, আমি অচেতন-চিতে চেতন, আমি বিশ্ব-তোরণে বৈজয়ন্তী, মানব বিজয় কেতন! ছুটি ঝড়ের মতন করতালি দিয়া স্বর্গ-মর্ত্ত্য করতলে, তাজি বোরবাক্ আর উচ্চৈস্রবা বাহন আমার হিম্মত-হ্রেস্বা হেঁকে চলে! আমি বসুধা-বক্ষে আগ্নেয়াদ্রি, বাড়ব-বহ্নি, কালানল, আমি পাতালে মাতাল অগ্নি-পাথর-কলরোল-কল-কোলাহল! আমি তড়িতে চড়িয়া উড়ে চলি জোর তুড়ি দিয়া, দিয়া লম্ফ, আণি ত্রাস সঞ্চারি ভুবনে সহসা, সঞ্চরি' ভূমি-কম্প! ধরি বাসুকির ফনা জাপটি', - ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি'! আমি দেব-শিশু, আমি চঞ্চল, আমি ধৃষ্ট আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্ব-মায়ের অঞ্চল! আমি অর্ফিয়াসের বাঁশরী, মহা- সিন্ধু উতলা ঘুম্-ঘুম্ ঘুম্ চুমু দিয়ে করি নিখিল বিশ্বে নিঝ্ঝুম্ মম বাঁশরী তানে পাশরি' আমি শ্যামের হাতের বাঁশরী। আমি রুষে উঠে' যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া, ভয়ে সপ্ত নরক হারিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া! আমি বিদ্রোহ-বাহী নিখিল অখিল ব্যাপিয়া! আমি প্লাবন-বন্যা, কভু ধরণীরে করি বরণিয়া, কভু বিপুল ধ্বংস-ধন্যা - আমি ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু-বক্ষ হইতে যুগল কন্যা! আমি অন্যায়, আমি উল্কা, আমি শনি, আমি ধূমকেতু-জ্বালা, বিষধর কাল-ফণি! আমি ছিন্নমস্তা চন্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী, আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি! আমি মৃণ্ময়, আমি চিন্ময়, আমি অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়! আমি মানব দানব দেবতার ভয়, বিশ্বের আমি চির দুর্জ্জয়, জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য, আমি তাথিয়া তাথিয়া মথিয়া ফিরি এ স্বর্গ-পাতাল-মর্ত্ত্য আমি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!! আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!! আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার, নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার! আমি হল বলরাম স্কন্ধে, আমি উপাড়ি' ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে। মহা- বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত, যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না - বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত আমি আমি সেই দিন হব শান্ত! আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন, আমি স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ-হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব-ভিন্ন! আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন! আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন! আমি চির-বিদ্রোহী বীর - আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!
দুলিতেছে তরি, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ, ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ? কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ। এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার। তিমির রাত্রি, মাতৃমন্ত্রী সান্ত্রীরা সাবধান! যুগ-যুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান। ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান, ইহাদের পথে নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার। অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরন কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পন। হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার গিরি সংকট, ভীরু যাত্রীরা গুরু গরজায় বাজ, পশ্চাৎ-পথ-যাত্রীর মনে সন্দেহ জাগে আজ! কান্ডারী! তুমি ভুলিবে কি পথ? ত্যজিবে কি পথ-মাঝ? করে হানাহানি, তবু চলো টানি, নিয়াছ যে মহাভার! কান্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর, বাঙালীর খুনে লাল হল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর! ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর! উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পূনর্বার। ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান, আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন্ বলিদান আজি পরীক্ষা, জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ? দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুশিয়ার!